খেলা
পাগল পরিবারে আমার জন্ম, কি ফুটবল, কি ক্রিকেট। একটা সময় ছিল যখন
বাংলাদেশে ক্লাব ফুটবল নিয়ে খুব মাতামাতি হত। আমি তখন বেশ ছোট ছিলাম,
দেখতাম আমার বড় ভাই-বোনেরা মোহামেডান-আবহানী দুই পক্ষের সাপোর্ট নিয়ে
প্রায়ই মজার মজার তর্ক করত। বাংলাদেশ যেদিন আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে
চ্যাম্পিয়ন হয়, আমার স্পষ্ট মনে আছে আমরা পরিবারের সবাই মিলে রেডিওতে
ধারাভাষ্য শুনছিলাম, রেডিওতে বাংলাদেশের বিজয়ের ঘোষণার সাথে সাথে আব্বা-আম্মাসহ পরিবারের সবাই মিলে যে কি আনন্দ করেছিলাম তা বলে বুঝাতে
পারবনা! বাড়িতে থাকলে এখনো আমরা সবাই মিলে একসাথে বসে যে কোন খেলা
টেলিভিশনে উপভোগ করি। বাইরে থাকাতে সেই মুহূর্তগুলো এখন অনেক মিস করি। আমার
আম্মা অন্যরকম খেলা পাগল একজন ব্যাক্তি, আমার জীবনে এ পর্যন্ত এরকম খেলা
পাগল মহিলা আমি দেখিনি। এই ৫০ বছর বয়সেও আম্মার কাছে ফুটবল-ক্রিকেটের
খুটি-নাটি সব খবর থাকে। বাংলাদেশ দলের যে কোন ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলা হোক
না কেন আম্মা তা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টেলিভিশনের সামনে বসে পুরো খেলাই
উপভোগ করে। বাংলাদেশ দল হারলে আব্বা খুনসুটিমূলক কথা দিয়ে আম্মাকে রাগায়,
আম্মা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলে,'দেখিও বাংলাদেশ আবার জিতবে'। আর বাংলাদেশ
জিতলে তো আমার আম্মার খুশি কে দেখে। আমিও একটা সময় মোটামুটি ভালই ক্রিকেট
খেলতাম। ক্রিকেটের জন্য কোনদিন ব্যাট অথবা বলের জন্য টাকা চেয়ে
আব্বা-আম্মার কাছে থেকে আমাকে বিমুখ হতে হয়নি। আম্মার খেলা পাগলামি নিয়ে
কিছু ঘটনার কথা না বললেই নয়-
১. বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট
ইন্ডিজ ক্রিকেট সিরিজ চলছিল, বিদ্যুৎ না থাকায় বাড়িতে একটা সাদা কালো
টেলিভিশনে ব্যাটারি দিয়ে খেলা দেখতাম। একদিন একটা ওয়ানডে ম্যাচ দেখার জন্য
আম্মা আমাকে বাজার থেকে একটা ব্যাটারি ভাড়া করে নিয়ে আসতে বলেছিলেন। আমি
বাজারে গিয়ে সারাদিন বাড়ি ফিরিনি, সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে ব্যাটারি ভাড়া করে
না আনার অপরাধে যে কি বকা খেতে হয়েছিল অবশেষে কেঁদেই ফেলেছিলাম।
২. তার কিছুদিন পরে বাংলাদেশ যখন নিউজিল্যান্ডকে হোয়াট ওয়াস করে, একদিন বিকেলে আম্মা আমাকে দুই শত টাকা বের করে দিচ্ছে্ন,
আমি টাকা দেখে বললাম, 'আম্মা কিসের টাকা'?
আম্মা বলল, 'বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে হোয়াট ওয়াস করেছে এই উপলক্ষে আজকে
তুই তোর বন্ধুদের নিয়ে কিছু খাবি তাই তোকে এই টাকা দিলাম'। আমি আম্মার
কান্ড দেখে পুরাই থ খেয়ে গেলাম!
৩. কিছুদিন আগের কথা, আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আম্মা বারান্দায় কিছুটা মন খারাপ করে বসে আছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,'আম্মা কোন সমস্যা'?
আম্মা বলল,'না সেরকম কিছু না গতকাল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হেরে গেছে'।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,'বাংলাদেশ তো কারো সাথে কোন সিরিজ খেলছেনা'।
আম্মা বলল,'বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দল পাকিস্তানের কাছে হেরে গেছে'।
(আমি আদৌ বাংলাদেশ প্রমিলা ক্রিকেটের তেমন কোন খোঁজ রাখিনি)
আমি বললাম, 'কিভাবে'?
আম্মা বলল,'বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দল মাত্র ৮২ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল'।
৪. এই কিছুদিন আগে, এক সকালে ঘুম থেকে ঊঠে
আমি আম্মাকে বললাম,'আম্মা মেসি নাকি আবারো বর্ষ সেরা ফুটবলার হয়েছে'?
(বিষয়টা তার আগের দিন একটু একটু আমার কানে এসেছিল)
আম্মা চোখ রাঙ্গিয়ে বলল,'যে বিষয়ে কিছু জানিসনা সে বিষয়ে কথা বলিস কেন'?
আমি বললাম, 'কেন'?
আম্মা বলল,'ওটা বর্ষসেরা ফুটবলারের ঘোষনা হয়নি, এই মৌসুমে মেসি সর্বোচ্চ
৭৩ টা গোল দিয়েছে বলে তাকে গোল্ডেন বুট পুরস্কার দেওয়া হয়েছে'।
আম্মার কথা শুনে আমার পুরাই নাস্তানাবুদ অবস্থা!
এখনো আমি ফোনে আম্মার কাছ থেকে খেলা-ধুলার খুঁটিনাটি খবর নিই। আবারো
বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ শুরু হয়েছে এবং আম্মা তা টেলিভিশনে মিস
করছেনা, শুধু আমি মিস করছি আম্মাকে।
তোমাকে অনেক ভালবাসি 'মা'।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন