শনিবার, ২৭ মার্চ, ২০২১

রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি

 

রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি 

রাজা টংকনাথ চৌধুরী,  ইংরেজ শাসনামলে বর্তমান বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলায় অবস্থিত মালদুয়ার পরগণার একজন জমিদার ছিলেন। রাজা টংকনাথ এর পূর্ব-পুরুষদের কেউ জমিদার ছিলেন না । বর্তমানে রাণীশংকৈল উপজেলা সদর হতে ৭ কিলোমিটার  পূর্বে কাতিহার নামক জায়গায় গোয়ালা বংশীয় নিঃসন্তান এক জমিদার  বাস করতেন । সেই জমিদারের মন্দিরে সেবায়েত হিসাবে কাজ করতেন টংকনাথের পিতা বুদ্ধিনাথ গোয়ালা জমিদার ভারত এর কাশি যাওয়ার সময় তাম্রপাতে দলিল করে যান যে, তিনি ফিরে না এলে মন্দিরের সেবায়েত বুদ্ধিনাথ জমিদারির মালিক হবেন । গোয়ালা জমিদার ফিরে না আসায় বুদ্ধিনাথ জমিদারির মালিক হন । তবে অনেকে মনে করেন এই ঘটনা বুদ্ধিনাথের দু-এক পুরুষ পূর্বেরও হতে পারে।

বুদ্ধিনাথের তিন ছেলে রামনাথ, টংকনাথ ও গৌরাঙ্গনাথ। এরমধ্যে রামনাথের অকাল মৃত্যু হয়, গৌরাঙ্গনাথ ছিলেন হাবা-গোবা, তবে টংকনাথ ছিলেন চতুর। বুদ্ধিনাথের মৃত্যু হলে টংকনাথ জমিদারির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।  

টংকনাথ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের আস্থা অর্জন করার জন্য মালদুয়ার স্টেট গঠন করেন । পরে রাজা টংকনাথের স্ত্রী রাণী শংকরী দেবীর নামানুসারে মালদুয়ার স্টেটের নাম করণ করা হয় রাণীশংকৈল যার কারণে বর্তমানে উপজেলা ও উপজেলা সদরটি রাণীশংকৈল নামেই অভিহিত।  

রাজা টংকনাথ চৌধুরী খুব বড় মাপের জমিদার না হলেও তার আভিজাত্যের কমতি ছিল না। ১৯২৫ সালের ১৮ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর হাউসে টংকনাথ চৌধুরীকে ব্রিটিশ সরকার চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করেন। কথিত আছে, টংকনাথের আমন্ত্রণে তৎকালীন বড়লাট এবং দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথ রায় রাণীশংকৈলে এলে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দকে টাকার নোট পুড়িয়ে রীতিমতো রাজকীয় অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন করান এবং বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার উপহার দেন। এর ফলে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে চৌধুরী উপাধি এবং দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথ রায়ের কাছ থেকে রাজা উপাধি পান।

বর্তমান রাজবাড়িটির ভঙ্গুর অবস্থা হলেও এর নির্মাণশৈলী অতি নিপুন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে রাজবাড়িটি নির্মিত হয়। রাজা টংকনাথের পিতা বুদ্ধিনাথের আমলেই রাজবাড়ি নির্মাণ কাজ শুরু হয় । বুদ্ধিনাথের মৃত্যুর পরে রাজা টংকনাথ রাজবাড়ির অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন। প্রায় ১০ একর জমির উপর রাজবাড়িটি অবস্থিত । বিশাল এক সিংহ দরজা দিয়ে রাজবাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে হয় । যদিও বর্তমানে সিংহ দরজার ছিটেফোঁটাও নেই। 

রাজবাড়ি সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব কোণে কাছারি বাড়ির অবস্থান এবং পূর্বে রয়েছে দুইটি পুকুর

লাল রংয়ের দালানটি স্থাপত্যশৈলীতে আধুনিকতার পাশাপাশি ভিক্টোরিয়ান অলঙ্করণের ছাপ সুস্পষ্ট ।  

রাজবাড়িটির মূল ভবনটি দ্বিতল বিশিষ্ট। উপরে উঠার জন্য রয়েছে সিড়ি, যদিও বর্তমানে এই সিড়িটি এখন ভেংগে পরেছে। 

উপর নিচ, দুই তলা মিলিয়ে ভবনটিতে রয়েছে অসংখ্য কক্ষ। এই কক্ষগুলো জমিদারির বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে ব্যাবহৃত হত। তাছাড়া বিনোদনের জন্য ছিল রঙ্গমহল এবং ছিল সভাকক্ষ। 

রাজবাড়ির ভবনের পশ্চিমে একটি কূপ দৃশ্যমান। রাজবাড়ির পানির যোগানের জন্যই মূলত এই কূপটি ব্যাবহৃত হত।    

বর্তমানে রাজবাড়ি ও তৎসংলগ্ন সব স্থাপনা অবহেলিত ও পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। 

রাজা টংকনাথ ১৯১১ সালে তৎকালীন বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে থেকে বি,এ পাশ করেন। তিনি দীর্ঘদিন বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। টানা ১৫ বছর তিনি জেলা বোর্ডের সদস্য ছিলেন ও প্রথম ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

রাজা টংকনাথ নিজ খরচে দুইটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতেন। ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অনুদান দিতেন। রাজা টংকনাথ একটি ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ২০০ ছাত্রের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থাসহ স্কুলের উন্নয়নের সার্বিক দায়ভার গ্রহণ করেন। তার পিতা বুদ্ধিনাথ চৌধুরীর নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন B.N INSTITUTE  বর্তমানে যা রাণীশংকৈল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত। 


তিনি শিক্ষানুরাগী হিসেবে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই স্থাপন করেননি, তার লাইব্রেরীও ছিল বিভিন্ন বইয়ে সমৃদ্ধ। তার সংগৃহীত বিভিন্ন বই এখনও দিনাজপুর সরকারী কলেজ ও কারমাইকেল কলেজ লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে ।

শিক্ষার পাশাপাশি হিন্দু ধর্মের প্রতিও ছিল রাজা টংকনাথের অগাধ অনুরাগ। রাজবাড়ি থেকে ২০০ মিটার দক্ষিণে হিন্দু ধর্মালম্বিদের জন্য তিনি নির্মান করেন  রামচন্দ্র বা জয়কালী মন্দির 

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্ত হলে রাজা টংকনাথ চৌধুরী ১৭ আগস্ট স্বপরিবারে ভারতে চলে যান। তবে কথিত আছে রাজা মৌমাছির আক্রমণের শিকার হয়ে অসুস্থ অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান এবং ১৯৪৮ সালে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

রাজা টংকনাথের তিন ছেলে  কর্মনাথ চৌধুরী, রুদ্রনাথ চৌধুরী এবং শেষনাথ চৌধুরী বর্তমানে ভারতেই অবস্থান করছেন।