এশিয়ার সর্ববৃহৎ আম গাছটির অবস্থান বাংলাদেশে। হ্যাঁ অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। বিস্ময়কর এই গাছটির অবস্থান ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাংগী উপজেলার হরিণমারী নয়াপাড়া গ্রামে। আপনাদের আজকে জানাবো ঠাকুরগাঁও ভ্রমণে এই গাছটি দর্শনের অভিজ্ঞতা।
যারা ঢাকা থেকে আসবেন তাদের বলে দিই কিভাবে আসবেন
ঢাকার শ্যামলী অথবা গাবতলী থেকে সরাসরি দূর পাল্লার বাস যাতায়াত করে ঠাকুরগাঁও জেলা সদরে। আপনি ইচ্ছা করলে ঢাকা থেকে সরাসরি ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাংগী উপজেলাগামী বাসেও আসতে পারেন। ঢাকা থেকে আসতে সময় লাগবে প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘন্টা। তবে আপনি যদি ৭/৮ ঘন্টা জার্নির পর বিশ্রাম নিতে চান সে ক্ষেত্রে আগে জেলা সদরে আসলেই ভাল। সেখানে রয়েছে ভাল মানের বেশ কিছু আবাসিক হোটেল। সড়ক পথের পাশাপাশি সরাসরি রেল পথেও এখন ঠাকুরগাঁও আসতে পারেন। পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও থেকে নিয়মিত তিনটি ট্রেন এখন ঢাকায় যাতায়াত করে। বাসে অথবা বাইকে জেলা সদর থেকে বালিয়াডাংগী উপজেলা সদরে প্রায় ২৩ কিলোমিটার যেতে সময় লাগে প্রায় ঘন্টাখানেকের মত। ছোট এই শহরটি ছিমছাম এবং গোছালো। শহরের চৌরাস্তা মোড় থেকে উপজেলার হরিণমারী বাজারে সরাসরি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চলাচল করে। আপনি ইচ্ছা করলেই চৌরাস্তা মোড় থেকে ইজিবাইক রিজার্ভ করে নিতে পারেন । রিজার্ভ করে প্রায় ১২ কিলোমিটারের পথটুকু যাতায়াতে নিবে সর্বোচ্চ দুইশত থেকে আড়াইশত টাকা আর যেতে সময় লাগবে প্রায় ঘন্টাখানেকের মত।
বালিয়াডাংগী উপজেলা শহর ছেড়ে প্রত্যন্ত গ্রাম -মাঠ পেরিয়ে সবুজের বুক চিরে এবার ছুটে চলা। এক সময়ের আঁকা-বাঁকা মেঠো পথগুলো এখন পিচ ঢালাইয়ে পেয়েছে উন্নয়নের রূপ। রাস্তার দুই ধারের অপরূপ সৌন্দর্য, সোনালী ধানের বিস্তৃত মাঠ, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে যেন আলাদাই এক প্রশান্তি। আর এই প্রকৃতিই যেন উত্তর জনপদের মানুষগুলোকে করে তুলেছে সরল ও মায়াময়।
উপজেলা সদর থেকে প্রায় ঘন্টাখানেক
পর পৌঁছে গেলাম উপজেলার হরিণমারী নয়াপাড়া গ্রামে। আম গাছের প্রবেশদ্বারে
যেতেই এক শিশু পথ আগলে ধরল আমাদের। প্রবেশ করতে হলে টিকেট কেটে প্রবেশ করতে হবে।
প্রতিজনের প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা করে। বাইক নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে প্রতি বাইকের জন্য আলাদা করে দিতে হবে ২০ টাকা।
ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পরল আম গাছসহ এর বিস্তৃত এলাকা। প্রথম দেখাতে বিস্মিত না হয়ে আপনি পারবেননা।
আম গাছটি পরিদর্শন করতে হলে আপনাকে মেনে চলতে হবে কিছু নির্দেশনা। নির্দেশনা সম্বলিত একটি নোটিশ বোর্ড দেখতে পাবেন আম গাছের সামনে।
গাছটির বয়স সম্পর্কে জানলে চমকে উঠতে পারেন আপনি! স্থানীয়দের কাছে যতদূর জানা যায় এ কাছের বয়স দুইশত বছরের অধিক।
প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে আম গাছটির অবস্থান।
উত্তরাধিকার সূত্রে গাছটির মালিক এখন নূর ইসলাম ও সাইদুর ইসলাম নামের দুই ভাই।
মূল কান্ড থেকে বের হওয়া ডালের সংখ্যা ১২টি তবে শাখা ডাল সহ এর সংখ্যা ১৯টি।
বয়সের সাথে সাথে গাছটি যেন আকাশ ছোঁয়ারও স্বপ্ন দেখেছে। মাটি থেকে এর উচ্চতা আনুমানিক ৮০ থেকে ৯০ ফুট। দানবাকৃতির গাছটির ব্যাসার্ধ প্রায় ৩৫ ফুট!
গাছটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে
অক্টোপাসের মত মাটি আঁকড়ে ধরা ডালগুলো। দূর থেকে মনে হয়, অনেকগুলো আমগাছ জড়াজড়ি
করে দাঁড়িয়ে আছে। আমের মৌসুমে আমের ভারে আরও নুয়ে থাকে ডালগুলো।
দর্শনার্থীরা যেমন গাছটি দেখতে আসেন তেমনি গাছটির পত্র পল্লবে সুমিষ্ট ছায়াতেও প্রাণ জুড়িয়ে যায় দর্শনার্থীদের।
গাছটি সূর্যপূরী জাতের। সূর্যপুরীর নামকরণ বা উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে একেবারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। জনশ্রুতি আছে, আনুমানিক তিন শ বছর আগে তৎকালীন ভারতবর্ষের উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরের সূর্যপুর এলাকায় এই আমের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। ধারণা করা হয়, ওখান থেকেই আমের জাতটি এখানে আসে। যেহেতু এই আম অত্যন্ত সুস্বাদু, তাই নাম ছড়াতে বেশি সময় লাগেনি। আশপাশের এলাকায় দ্রুত পরিচিতি পায় এ আম। ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সূর্যপুরী আমগাছ পাওয়া যায়। সূর্যপুরী ছোট মাঝারি আকারের আম, দেখতে সরু। গড় ওজন ১৪০ থেকে ১৬০ গ্রাম। আমটি পোক্ত অবস্থায় হালকা সবুজ, পাকলে ত্বক হলুদ রং ধারণ করে। আঁটি ও খোসা পাতলা। সামান্য আঁশযুক্ত হলেও আমটি বেশ রসাল। এই আমের খাদ্যাংশ ৫৬ শতাংশ, মিষ্টতা প্রায় ১৭ শতাংশ। সূর্যপুরী আমে ভিন্ন ধরনের সুগন্ধ আছে। জুন মাসের শেষে আমটি পোক্ত হয় আর পুরো জুলাই মাস বাজারে পাওয়া যায়। এই গাছটি থেকে প্রতিবছর ১২০ থেকে ১৫০ মণ আম পাওয়া যায়। খ্যাতির কারণে এ গাছের আমের কদর একটু বেশি। ব্যতিক্রমী গাছের সুস্বাদু আম পেতে আগ্রহী অনেকেই। অন্যান্য গাছের আম যেখানে বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকায়, এই গাছের আমের দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকা।
বিস্ময়কর এই গাছটি দেখতে প্রতিদিনই অনেক দর্শনার্থী আসেন। নারী, পুরুষ, কিশোর এবং কি শিশু দর্শনার্থীরাও আসেন এক পলক এই গাছটি দেখার জন্য। গাছটি দেখতে এসে দর্শনার্থীরা যাতে গাছের কোন প্রকার ক্ষতিসাধন না করেন সে জন্য রয়েছে বিশেষ নির্দেশনা এবং জরিমানার ব্যাবস্থা। দূরদুরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের জন্য এখানে রয়েছে হালকা স্ন্যাক্স এবং খাবারের ব্যাবস্থা। এছাড়াও রয়েছে বিশ্রামাগার এবং শৌচাগার।
ঐতিহ্যের ধারক এশিয়ার বৃহত্তম এই
আম গাছটি যেমনি বিস্ময়কর তেমনি এলাকার পর্যটন বিকাশে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।