শুক্রবার, ৩ জানুয়ারী, ২০২০

সীমান্তে কালীপূজা ও ভারত- বাংলাদেশ মিলনমেলা


ঠাকুরগাঁও জেলার সীমান্তঘেঁষা শান্ত জনপদ হরিপুর উপজেলা।  এই উপজেলার গোবিন্দপুর সীমান্তে প্রতি বছর জামরকালির পূজা উপলক্ষ্যে এক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয়রা এই মেলাকে পাথরকালির মেলা হিসেবেই অভিহিত করেন। মেলার অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে মেলাপ্রাঙ্গণ সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার দুই পাশে দুই দেশের হাজার হাজার মানুষ মিলিত  হয়ে সীমান্তের মিলনমেলা ঘটায়।

x

সাধারণত কার্তিক মাসের আমাবষ্যা তিথীতে কালিপূজা হলেও এখানে মেলা বসে আগ্রহায়নে কৃষকেরা আমন ধান ঘরে তোলার পর।  মেলা প্রাঙণের আশেপাশে ধান ক্ষেতের ক্ষতি এড়াতেই এই সময়টায় মেলার আয়োজন করে আয়োজকরা।  

মেলাপ্রাঙ্গণ মুখরিত হয় নারী-পুরুষ ও শিশুদের সরগমে। শুধু স্থানীয়রা নয় বিভিন্ন বাহনযোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের আগমন ঘটে এখানে । 

মেলা মানেই হরেক রকম খাবারের সমাহার। মুখরোচক বিভিন্ন পদের আচার, গুড়ের জিলাপী ও বিভিন্ন মিষ্টির দোকানি পশরা সাজান এই মেলায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন ফলফলাদি, বাড়ির প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র ও কাপড়-চোপড়ের দোকানও বসে এই মেলায়। 

মেলায় বিনোদনের জন্য থাকে  শিশুদের নাগরদোলা। শামুক-ঝিনুকের কারুকার্যমন্ডিত মালা ও বিভিন্ন শো পিচও শোভা পায় এখানে।  থাকে নারী ও পুরুষের বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী। মেলায় থাকে বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্র ও হরেক রকম বাঁশির দোকান। 

সমঅধিকারের এই যুগে পুরুষ বিক্রেতার পাশাপাশি মেলায় থাকে মহিলা বিক্রেতাও।

যেহেতু জামরকালির পূজাকে কেন্দ্র করে এই মেলা হিন্দু ধর্মালম্বের পূণ্যার্থীরা মেলার ফাঁকেই সেরে নেন পূজো। ঢাকি ও সানাই বাদকের এই সুর পূন্যার্থীদের পূজা অর্পনকে করে তুলে শুভ্র ও প্রানবন্ত।

পাঠা বলি কালিপুজার অন্যতম অনুষঙ্গ। মানতকারিরা কালির সামনে বলির জন্য নিয়ে আসেন পাঠা।

এই জামরকালি  পূজার সঠিক ইতিহাস  জানা না গেলেও ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগে থেকেই দুই দেশের স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় এই কালির পূজা করে আসছেন। আগে এখানে পাথরের এক কালি মূর্তি ছিল তাই স্থানীয়রা এই মেলাকে পাথরকালির মেলা হিসেবেই অবিহিত করেন।  

মেলার পাশেই ছোট নদী কুলিক। মূলত এই নদীর পাড়েই মেলাপ্রাঙ্গণ। আর এই নদীই এখানে সীমান্ত হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশকে বিভক্ত করেছে। দর্শনার্থীদের মূলত উদ্যেশ্য নদী পার হয়ে কাটাতারের বেড়ার পাশে যাওয়া। স্থানীয়রা এদিন দর্শনার্থীদের নদী পারাপারের জন্য বাঁশ বা কাঠ দিয়ে তৈরী করেন অস্থায়ী সাঁকো। স্থানীয় ভাষায় এই অস্থায়ী সাঁকোকে বলা হয় 'ধারা'। তবে সাঁকো দিয়ে পারাপারের জন্য দর্শনার্থীদের প্রতিজনে দিতে হয় দশ টাকা করে।  

নদী পার হলেই বিভাজনকারী সীমান্ত পিলার। সীমানা পিলার পার হয়ে প্রায় ২০০ মিটার নো ম্যান ল্যান্ডসের ভূমি পার হলেই পৌঁছানো যাবে কাটা তারের বেড়ার পাশে। অন্যদিন সীমান্তের এই জায়গায় প্রবেশ নিষেধ থাকলেও দুই দেশের সীমান্তবাহিনীর সমঝোতায় এই দিনে এই অবাঞ্চিত প্রবেশে নেই বাঁধা। 



কাঁটাতারের পাশে পৌঁছালেই সবাই হণ্যে হয়ে খুঁজে সীমান্তের ওপারের প্রিয় মুখটি। প্রিয়জনদের সাথে এই সাক্ষাত ও আবেগের কথোপকথন হয়ত টাকার অংকে অমূল্য। 

দুই ধারেই নামে অসংখ্য মানুষের ঢল। কেউ বা প্রিয়জনকে একটুখানি দেখার জন্য, কেউ বা আসে এই সীমান্তের মিলনমেলা দেখতে। শুধু বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নয় ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকেও হাজার হাজার মানুষ আসে রায়গঞ্জ জেলার এই বিন্দোল সীমান্তে। 



অনেকেই ডিজিটাল ডিভাইস বা ক্যামেরায়  প্রিয়জনের স্মৃতি ধারণ করে রাখেন এখানে। 


শুধু কথোপকথন বা আবেগের বিনিময় নয়, প্রিয়জনদের  সাথে বিনিময় হয় প্রিয়জনদের প্রিয় জিনিসিও।  তবে জিনিস বিনিময়ে কাঁটাতারের কারণে বিড়ম্বনাও কম নয়। 

ওপারের মানুষদের ইলিশ খুব প্রিয় তাই এপার থেকে ইলিশ বেচাকেনাও চলে হরদম। 

লাখো মানুষের পদচারনায় বছরের এই দিনটিতে সীমান্তের এই অঞ্চলটি হয়ে উঠে প্রানবন্ত। কেউ বা শিকড়ের খোঁজে কেউ বা পাসপোর্ট ভিসা ছাড়ায় প্রিয়জনদের একটুখানি দেখার জন্য। 

কাঁতা তারের এই বেড়াটি দুই দেশের ভূমিকে আলাদা করলেও আলাদা করতে পারেনি দুই দেশের মানুষের আবেগকে, দুই দেশের মানুষের সম্পর্ককে। 


দিনশেষে সবাইকে ফিরতে হয় আবার নিজ গন্তব্যে।প্রিয়জনদের সাথে মিলিয়ে থাকা এই আবেগ, এই অনূভুতি সীমান্তে মিলিয়ে যায় সীমানাহীনভাবে।