ঠাকুরগাঁও জেলা সদর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে রানীশংকৈল উপজেলায়
খুনিয়াদিঘি বধ্যভূমির
অবস্থান। জেলা সদর থেকে দুই পথে খুনিয়াদিঘি বধ্যভূমিতে যাওয়া যায়। ঠাকুরগাঁও সদর
থেকে বালিয়াডাংগী উপজেলা হয়ে অথবা আপনি ইচ্ছা করলে ঠাকুরগাঁও সদর থেকে পীরগঞ্জ
উপজেলা হয়েও রানীশংকৈল উপজেলার খুনিয়াদিঘি বধ্যভূমিতে যেতে
পারেন। এ যাত্রায় মোটরবাইক যোগে আমার ভ্রমণ সঙ্গী হয়েছে ভ্রমণ পিপাসু আমার তিন বন্ধু এন সি দাস, বিপু বিশ্বাস ও জুয়েল রানা
মাসুদ।
উত্তরবংগের এই শান্ত নীরব জনপদ চিড়ে ঝকঝকে পিচঢালা পাকা রাস্তায় আপনি খুঁজে
পাবেন উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি। ফুরফুরে হিমেল বাতাসে আস্বাদিত হবেন স্বাধীণতার
স্বাদে, যে স্বাধীণতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন এ দেশের লাখো শহীদ।
রাস্তার দুই ধারের দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ, কৃষকের কর্মযজ্ঞ ও
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিমোহিত করবে আপনাকে। এ দৃশ্য দেখে নিশ্চয় আপনার মঞ্জুর
হাসানের 'আমি প্রকৃতি হব' কবিতার দুটি লাইন আবৃতি করতে ইচ্ছে করবে-
'আমি পিপীলিকার মত অনন্তকাল হাঁটব
আমি উদাস কবির মত পথে প্রান্তরে ঘুরব
আমি প্রকৃতি হব।'
রাণীশংকৈল উপজেলা সদরের শিবদিঘি মোড়ে পৌঁছালেই চোখে পরবে একটি নামফলক । এই নাম ফলকে উপজেলার
বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও অবস্থান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আছে প্রত্যেকটি স্থানের
সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও।
নামফলক থেকে ১০০ মিটার পশ্চিমে গেলেই চোখে পরবে পুলিশ থানা কর্যালয়ের
সাইনবোর্ড। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বর্তমান ঠাকুরগাঁও জেলার
সীমান্তবর্তী হরিপুর,বালিয়াডাঙ্গী,রানীশংকৈল
উপজেলা এলাকায়
মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকিস্থানী
হানাদার বাহিনী এই থানা চত্তরে ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। প্রতিদিন
শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের লোকদের ধরে আনা হতো এই ক্যাম্পে।
থানা কার্যালয় থেকে সোজা দক্ষিণের রাস্তা বেয়ে এবারে আমাদের গন্তব্য
খুনিয়াদিঘি বধ্যভূমিতে।
প্রায় ৩০০ মিটার রাস্তা অতিক্রম করলেই রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে পুকুর পাড়ে
চোখে পরবে একটি চৌকঠ অবকাঠামো।
এই চৌকঠ অবকাঠামোর ভিতরে প্রবেশ করলে চোখে পরবে এই বধ্যভূমিতে শায়িত শহীদদের
স্বরণে নির্মিত মূল স্মৃতিস্তম্ভটি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে জাতীয় চার নেতার
মধ্যে অন্যতম আবুল
হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এই স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন।
এবার আসা
যাক এই দিঘির নামকরণের ইতিহাস নিয়ে। প্রচলিত আছে, প্রায় দুইশত বছর আগে স্থানীয় এক জমিদার ৬ একরের বিশাল এই দীঘিটি খনন
করেন। এই এলাকার ব্যবসায়ীরা নির্জন ও জঙ্গলাকীর্ণ দীঘির পাশ দিয়েই ব্যবসা করতে
যেতেন ভারতের রায়গঞ্জে। একবার কে বা কারা এক ব্যবসায়ীকে খুন করে দীঘির পাড়ে
ফেলে রেখেছিল। তখন থেকে এই দীঘির নাম হয়ে যায় খুনিয়া দীঘি।
মুক্তিযুদ্ধের
সময় হানাদার ক্যাম্পে সারাদিন নির্যাতনের পর ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধা এবং
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোকদের ধরে নিয়ে আসা হত এই পুকুরের পাড়ে। দীঘি
পাড়ের শিমুল গাছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতের তালুতে লোহার পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রেখে
বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করতো। কখনো কখনো
হত্যার পূর্বে লোকজনকে কবর খুঁড়তে বাধ্য করতো। হত্যার পরে দীঘি পাড়ের উঁচু জমিতে
মাটি চাপা দিতো পাক হানাদাররা।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি আর্মি, রাজাকার,আলবদর
আর আলশামসদের সহায়তায় ২০০০ থেকে ৩০০০ মানুষকে খুনিয়া দীঘিতে হত্যা করা হয়। এর ফলে মানুষের রক্তে দীঘির পানির রং
হয়ে যায় ঘন খয়েরি। রক্ত,লাশ,কঙ্কালে ভরপুর খুনিয়া
দীঘি নামটি আরো সার্থক হয়ে উঠে।
শহীদদের আত্মত্যাগের স্মৃতিকে ধরে রাখতে পুকুরের দক্ষিণপাড়ে নির্মিত হয়েছে নতুন একটি স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিস্তম্ভের মূল ফটকের পাশেই নাম ফলকে সংযুক্ত করা হয়েছে কয়েকজন শহীদের নাম। নতুন প্রজন্মের কাছে এই সৌধ তুলে ধরছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। শহীদদের আত্মত্যাগ প্রেরণা জোগাচ্ছে এই প্রজন্মকে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে রাঙানো
স্মৃতিসৌধটি খুনিয়া দিঘিতে ৭১’এর জলন্ত প্রতীক হয়ে বাংলার স্বাধীনতা আজও বহন করছে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ আর ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
দেশ প্রেম বুকে নিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের প্রতি। সেই সাথে সকল মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জানাই গভীর শ্রদ্ধা।